জেনেনিন ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার ব্রহ্মচর্য্য জীবনের সম্যক মর্মগাঁথা কাহিনীঃ-
এই ধরা ধামে ব্রহ্মজ্ঞ মহাযোগী শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার শুভ আবির্ভাব হয়ে ছিল ১১৩৭ বঙ্গাব্দ, ১৭৩০ খ্রিষ্টাব্দ, শুভ জন্মাষ্টমী তিথি, শনিবার দিন। তিনির শুভ আবির্ভাবের সেই মহাপূণ্যময় স্হানটি ছিল- পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত উত্তর ২৪ পরগণা জেলা স্হিত বারাসাত মহকুমাধীন দে-গঙ্গা থানার অধুনা লুপ্ত কাঁকড়া, বর্তমান কচুয়া নামক গ্রামে। যেহেতু বর্তমান কলিযুগে ধরাধামে আগত সকলেরই মানব দেহ নশ্বর তাই জন্মিলে মরিতে হয়। সেহেতু তিনিও তিনির সুদীর্ঘ ১৬০ বৎসরের মানব জীবনের নানা বৈচিত্র ময় মহালীলা সাঙ্গ করে মহাপ্রয়ানে (তিরোধান) গিয়ে ছিলেন ১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৯৭ বঙ্গাব্দ, ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দ। স্হান-- বারদী ধাম, সোনারগাঁ , জেলা-নারায়ণগঞ্জ, বাংলাদেশ।
তদেজতি তন্নৈজতি তদ্দূরে তদ্বন্তিকে। তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বস্যাস্য বাহ্যতঃ।
তিনি এক জায়গায় অবস্হিত, তবু চলমান, আবার তিনি চলৎশক্তি রহিত। তিনি অতি দূরে, আবার অতি নিকটে তিনি সমস্ত জগতের অন্তরে ও বাহিরে সর্বস্হানে পরিব্যাপ্ত।
মাতা কমলাদেবীর গর্ভে ,পিতা রামকানাই ঘোষাল মহাশয়ের ঔরষ জাত চতুর্থ পুত্র (সর্বকনিষ্ঠ) হলেন লোকনাথ। শ্রী রামকানাই ঘোষাল একটা কথা সকলকে প্রায়ই বলতেন-- "যদি কোন বংশের অন্তত একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিও বৈদিক সন্ন্যাস নিয়ে থাকেন। তবে সেই প্রজ্ঞাবান বৈদিক সন্যাস গ্রহনকারী ব্যক্তি তাঁর বংশের ঘোর নরকে থাকা অতীত ৬০ (ষাট )কুল ও আগামী ৬০ ( ষাট ) কুল সহ মোট ১২০ ( একশত বিশ ) কুল পর্য্যন্ত সকলকে। তাঁর স্বীয় কর্মের দ্বারা সেই ঘোর নরক থেকেও উদ্ধার করতে সক্ষম হয়ে থাকেন।" "জীবিতে বাক্য পালন শাস্ত্রের কথা" তাই সুযোগ্য পুত্র সব সময় পিতা মাতার বাধ্য হয়। শুধু তাই নয় জীবিতাবস্হায় তাঁর পিতা ও মাতার বাক্য রক্ষা করতে সদা সর্বদা তৎপর থাকেন।
বাল্য বয়সে লোকনাথ ছিলেন একেবারেই উত্তম চরিত্রের অধিকারী। তাই তাঁর জন্মদাতা পিতা রামকানাই ঘোষাল মহাশয়ের একান্ত ইচ্ছা অনুযায়ী ১১৪৮ বঙ্গাব্দে লোকনাথের উপনয়ন হয়ে ছিল। উপনয়ন কালে তিনির বয়স হয়ে ছিল মাত্র ১১ ( একাদশ )বৎসর। তখন বিখ্যাত পণ্ডীত শ্রী ভগবান গাঙ্গুলি মহাশয় লোকনাথের উপনয়ন স্হানীয় সংস্কার ক্রিয়াদির সকল কর্ম সুচারু রূপে সম্পন্ন করে ছিলেন। অতঃপর দণ্ডীবেশে আচার্য্য গুরু শ্রীভগবান গাঙ্গুলী ও বন্ধু শ্রী বেণীমাধব বন্দোপাধ্যায় সমেত একত্রে কঠোর ব্রহ্মচর্য ব্রত পালন করার সিদ্ধান্ত নেন শিশু লোকনাথ। অতঃপর সেই মহৎ কার্য সম্পাদন করার নিমিত্তে নিজের অতি পরিচিত শৈশবের বন্ধু বান্ধবে ভরপুর প্রীয় জন্মস্হান কচুয়া নামক গ্রামটি ত্যাগ করে ছিলেন লোকনাথ।
সেই সংকল্প সিদ্ধির নিমিত্তে যথাসময়ে তাঁরা সকলে নিজ গ্রাম কচুয়া এসে একত্রিত হলেন। তথাথেকে শুভ যাত্রার প্রারম্ভে তাঁরা প্রথমেই গেলেন মা ভবতারিনী দেবীর পূণ্য ভূমি কালীঘাটে। সেখানে গিয়ে সর্বপ্রথমে তাঁরা সকলে মা ভবতারিনী দেবীকে দর্শণ করে তিনির আশীর্বাদ নিলেন। তার পর তাঁরা মা ভবতারিনী দেবীর আশীর্বাদ নিয়ে সেই কালীতীর্থ কালীঘাট থেকে গঙ্গানদী পার হয়ে আরো পশ্চিম দিকে বহুদূর পথ অতিক্রম করলেন। অতঃপর সেখানে দুর্গম অরণ্য পথের এক নির্জণ পাহাড়ের গুপ্ত মুখে আস্তানা পেতে কঠিন ব্রতাচারণ ও হটযোগ সাধন আরম্ভ করে দিলেন তাঁরা। সেখানে অবস্হান কালে লোকনাথ সর্বপ্রথমে নক্তব্রত দিয়ে শুরু করলেন তাঁর ব্রহ্মচর্যাশ্রম জীবনের শুভ সূচনা।
তিনি তাঁর ব্রহ্মচর্যাশ্রম জীবনের প্রারম্ভে ক্রমান্বয়ে আরম্ভ করলেন একান্তব্রত, তারঃপর ত্রিরাত্র ব্রত, অবশেষে ক্রমান্বয়ে পঞ্চরাত্র ব্রত, নবরাত্র ব্রত, দ্বাদশাহ ব্রত পক্ষাহ ব্রত ও সর্বশেষ মাসাহ ব্রত সমাপন করলেন। প্রত্যেকটি ব্রতই উপবাস থেকে একে একে সবগুলো ব্রতকে কঠিন ভাবে করায়ত্ত করলেন এই মহাযোগী লোকনাথ। তারপর সেখান থেকে গুরুদেব ভগবান গাঙ্গুলি সমেত বর্ধমান গেলেন লোকনাথ। বর্ধমান থেকে দামোদর নদী পার হয়ে বেরুগাঁ এসে গহিন অরণ্য প্রান্তরে গভীর বণের মধ্যে কিছু কাল অবস্হান করেন তাঁরা । আবার অরণ্য থেকে বের হয়ে এসে তাঁরা উত্তর ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্হান দর্শন করলেন। সেখানকার সকল তীর্থস্হান দর্শন সমাপ্ত করার পর। পূনঃরায় তাঁরা দেবভূমি হিমালয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।
এমনি ভাবে একটানা ৪০ বৎসর যাবৎ কঠিন বহ্মচর্য ও ব্রতাদি পালন করে ছিলেন এই মহামানব। আবশেষে বাবা লোকনাথ নিজে ধ্যান ও সমাধির উপযুক্ত হয়ে উঠতে সক্ষম হলেন। এ বিষয়টি সমন্ধে সম্যক ভাবে জানতে পেরে অতঃপর গুরুদেব শ্রীশ্রী ভগবান গাঙ্গুলি লোকনাথকে সন্ন্যাস দীক্ষা দিলেন এবং তাঁকে নতুন নাম দিলেন লোকনাথ ব্রহ্মচারী । অতঃপর গুরুদেব শ্রীশ্রী ভগবান গাঙ্গুলি তাঁদের উভয়কে নিয়ে ভারতের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল হয়ে একদা কাবুলের পথে বেড়িয়ে পড়লেন। ১১৭৪ বঙ্গাব্দ থেকে ১২৯২ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত টানা ১৯ বৎসর যাবৎ তাঁরা বিভিন্ন পাহাড় পর্বত ও গুহাতে অবস্হান করে তাদের কৃত কর্ম সম্পাদন করলেন। অতঃপর একদিন এসে পারস্য কবি শেখ সাদীর গৃহে হাজীর হলেন এবং সেখানে তিনির আতিথেয়তা গ্রহণ করলেন।
কাবুলে পারস্য কবি শেখ সাদীর বাড়িতে পুরো একটি বছর ছিলেন লোকনাথ ব্রহ্মচারী। তথা থেকে তাঁরা উভয়ে আরবী ভাষা ও পবিত্র কোরানশাস্ত্র শিক্ষা করলেন। সেই সাথে তাঁরা ইসলাম ধর্মের দর্শন ও মূলতত্ত্ব সমন্ধে উভয়ে সম্যক অবগত হলেন। এবার কাবুল পরিত্যাগ করে লোকনাথ ব্রহ্মচারী ও বেণীমাধব উভয়ে এলেন পরম তীর্থ কাশীধামে। সেখানেই তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল হিতলাল মিশ্র (ত্রৈলঙ্গস্বামী) মহোদয়ের সাথে। ঠিক সেই সময়ে সাথে সাথেই গুরু দেব ভগবান গাঙ্গুলী মহাশয় লোকনাথ ব্রহ্মচারী ও বেণীমাধব বন্দোপাধ্যায় এই দুই শিষ্য দ্বয়ের ভবিষ্যৎ কর্ম পন্থা নির্ধরনের দায়িত্ব তুলেদিলেন শ্রীশ্রী ত্রৈলঙ্গস্বামীর ( হিতলাল মিশ্র ) হাতে।
গুরুদেব শ্রী ভগবান গাঙ্গুলি পরদিন গঙ্গাস্নান সমাপনান্তে কাশীর মনিকর্ণিকার ঘাটে যোগাসনে বসে ধ্যানমগ্ন হয়ে তাঁর প্রাচীন মানব দেহটি ত্যাগ করলেন। ঐ সময়ে গুরুদেব শ্রী ভগবান গাঙ্গুলীর বয়স হয়েছিল ১৫০ বছর। গুরুদেব শ্রীশ্রী ভগবান গাঙ্গুলির দেহত্যাগের সময়ে অবশ্য শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী ও শ্রীশ্রী বেণীমাধব বন্দোপাধ্যায় উভয়ের বয়স ৯০ বছর অতিক্রম হয়ে গিয়েছিল।
এবার তাঁরা উভয়ে কিছুকাল শ্রীশ্রী ত্রৈলঙ্গ স্বামীর আশ্রমে থেকে যোগ সাধনা শিখলেন। যোগ সাধনা শিক্ষা করার একপর্যায়ে লোকনাথ ব্রহ্মচারী নিজেকে একজন ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষরূপে নিজেই জানতে পারলেন। তারপর সাথে সাথেই তিনি বেরিয়ে পড়লেন বিশ্ব ভ্রমনে।
লোকনাথ ব্রহ্মচারী তাঁর পরিব্রাজন কালের প্রথমেই পদব্রজে গেলেন আফগানিস্তান হয়ে সুদূর মদিনায়। মদিনায় গিয়ে লোকনাথ ব্রহ্মচারী প্রথমেই সাক্ষাৎ করলেন সেখানকার বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ জনাব আবদুল গফুর সাহেবের সাথে। অতঃপর মদিনায় ব্রাহ্মণ জনাব আবদুল গফুর সাহেবের সাথে বেশ কিছুদিন একত্রে অতিবাহিত করলেন তিনি। তারপর আফগানিস্হান থেকে ভ্রমন শেষ করে বর্তমান স্হান থেকে প্রত্যাবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিলেন বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী। অতঃপর মহাযোগী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী আবার ফিরে এলেন তাঁর নিজের শৈশবের স্মৃতি বিজরীত বারদী ধামে। যেটি বর্তমানে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলাধীন সোনারগাঁ অবস্হিত জননন্দিত বারদী ধাম নামে সুপ্রশিদ্ধ।
অবশেষে সকল চড়াই উৎরাই পার করে মহাযোগী পরিব্রাজক বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী বারদী ধামে এসে পৌঁছলেন। এখানেই তিনি তিনির লীলাময় জীবনের সর্বশেষ কিছু সময় অতিবাহিত করলেন গোয়ালিনী মায়ের সেব যত্নে। অতঃপর এক শুভ দিনের শুভ সময়ে এই ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ তাঁর লীলাময় কঠিন দীর্ঘ ব্রহ্মচর্য্য জীবনের ইতি টানার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তিনি তাঁর স্বীয় ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর নিমিত্তে ইহজগতের বিচিত্রময় সকল লীলা শাঙ্গ করে ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১৯ জ্যৈষ্ঠ, এই বারদী ধামেই ধ্যান যোগে প্রাচীন মনুষ্য দেহটি ত্যাগ করলেন এই ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ। তখন শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার বয়স হয়েছিল ১৬০ ( একশত ষাট ) বৎসর।
প্রণাম মন্ত্র
( ১ ) ওঁ যোগীন্দ্রায় নমস্তভ্যং ত্যাগীস্বরায় বৈ নমঃ ।
ভুমানন্দ স্বরূপায় লোকনাথায় নমো নমঃ ।।
( ২ ) নমামি বারদিচন্দ্রং নন্দন কাননেস্মরং হরিম ।
নমামি ত্রিলোকনাথাং লোকনাথং কল্পতরুম ।।
( ৩ ) নমস্তে গুরুরূপায় সর্ব্ব সিদ্ধি প্রদায়িনে।
নমস্তে শিবরূপায় ব্রহ্মাত্মনে নমো নমঃ।।
লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার একটি অমৃত বাণী--
“এই বিরাট সৃষ্টির মধ্যে এমন কিছু নেই, যাকে উপেক্ষা করা চলা যায় বা একেবারে ছোট ভাবা যায়। ইহ জগতে পরম ব্রহ্মের সৃষ্ট প্রতিটি বস্তু বা প্রাণী নিজ নিজ স্থানেই তার স্ব-মহিমায় মহিমান্বিত আছে জানবি”
-- শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী।
বাবা আপনি কল্পতরু আপনার সকল ভক্তের দুঃখ নিবারন করুন। আমাদের সকলের সর্বাঙ্গিন মঙ্গল বিধান করুন । আপনার সকল ভক্তগণ যেন দূর্বার ন্যায় অনাদিকাল এই বিশ্ব সংসারে সুখে শান্তিতে জীবিত থাকেতে পারে সে আশীর্বাদ করুন বাবা আপনি সকলকে নিরন্তর। সেই সাথে আমি এই নরাধম আপনার একজন অধম ভক্ত, কায়মন বাক্যে পরম শ্রদ্ধাযুক্ত মনে প্রণাম জানাই আপনার শ্রীচরণ যুগলে। কৃপা করে সকল বিপদের হাত থেকে রক্ষা করুন বাবা আপনার এই অধম সন্তানেরে। সেই মিনতি জানাই বাবা বারে বারে তব শ্রীচরণ কমলে।
আমার শহর জগদ্দল - আমাদের পোস্টটি আরও সকলের কাছে পৌঁছে দিতে শেয়ার করুন। পেজে লাইক ও ফলো করে আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন।