শ্যামনগরের ঐতিহাসিক ব্রহ্মময়ী কালীবাড়ির ইতিহাস

উত্তর চব্বিশ পরগনার শ্যামনগরের হুগলী নদীর তীরে এই জনপদ বহু কারণেই বিখ্যাত। তার অন্যতম, শ্যামনগর ব্রহ্মময়ী কালীবাড়ি। উনিশ শতকের গোড়ায়, ১৮০৯ খ্রীঃ বৈশাখী পূর্ণিমায় কলকাতার পাথরঘাটার জমিদার গোপীমোহন ঠাকুর ব্রহ্মময়ী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দির প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে অনেক কাহিনী প্রচলিত। জমিদার গোপীমোহন মা কে কন্যা রূপে আকাঙ্ক্ষা করে এক মাত্র কন্যা হিসাবে পেয়েছেন ব্রহ্মময়ীকে। 


৯ বছর বয়সে ব্রহ্মময়ীর বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। বিয়ের দিন সকালে ব্রহ্মময়ী গঙ্গা স্নানের ইচ্ছা প্রকাশ করলে পাল্কিতে চাপিয়ে ব্রহ্মময়ীকে আহিরীটোলা ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। কন্যা সহ পালকি গঙ্গায় চোবানোর পরে আর ব্রহ্মময়ীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই সংবাদে গোপীমোহন কন্যার শোকে মুহ্যমান হয়ে ছিলেন।


একদিন দেবী স্বয়ং গোপীমোহনকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেন যে, তাকে মাতৃমূর্তি রূপে মূলাজোড় গঙ্গার পাড়ে জঙ্গলের মাঝে পাওয়া যাবে এবং গোপীমোহন সেখানেই যেন তাঁর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে যেখানে মন্দির সেখানেই নদীর ধারে কন্যা ব্রহ্মময়ীর মৃতদেহ পাওয়া যায়। এরপর স্বপ্ননির্দিষ্ট স্থানে পাষাণময়ী এক দেবীমূর্তি পাওয়া যায়, মৃত্তিকায় অর্ধ প্রোথিত, কষ্টিপাথরের দক্ষিণা কালীমূর্তি, পদতলে শায়িত মহাদেব বিগ্রহ। 

ছবি - মা ভবতারিণী, দক্ষিনেশ্বর 
(মন্দির কতৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা থাকায় শ্যামনগরের ব্রহ্মময়ী মায়ের ছবি তোলা যায়নি)


স্বপ্নদিষ্ট হয়েই গোপীমোহন মন্দির নির্মাণ করান। ব্রহ্মময়ীর মন্দিরটি নবরত্ন মন্দির, এরকম মন্দির পশ্চিমবঙ্গে বেশী দেখা যায় নি। মন্দিরের দক্ষিণ ও বাম পার্শ্বে ছয়টি করে সারিবদ্ধ শিব দেউল। শিব মন্দিরগুলো অবশ্য গোপীমোহন পুত্র প্রসন্ন কুমার সম্পূর্ণ করেন। মন্দিরের আভ্যন্তরীণ বাতিগুলি ইউরোপীয় প্রভাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।  মন্দিরে সোপানের কাছে দুই স্তম্ভের উপর শ্বেত পাথরের দুই সিংহ মূর্তি। উপরে আরও দুটি স্তম্ভ যার ওপর দুটি বিষ্ণু মূর্তি। অনুমান করা হয় এই মূর্তিদুটো ব্রহ্মময়ী মূর্তির চাইতেও প্রাচীন, এদের রাজশাহীর কোন জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ির সময় পাওয়া যায়।


পাথুরিয়াঘাটের ঠাকুর ঐতিহ্যগত ভাবে বৈষ্ণব অথচ তারাই শক্তি মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন - এটা বিস্ময়কর বলে মনে হতে পারে। এর পেছনেও ঠাকুর পরিবারের অন্য আকাঙ্ক্ষা বা সামাজিক প্রতিষ্ঠার কারণ ছিল কি? পীরালি ব্রাহ্মণের সমাজ প্রতিষ্ঠা ও ব্রাহ্মণ সমাজের নেতৃত্ব করার করার আকাঙ্ক্ষা কি এই সব কর্মকাণ্ডের পেছনে কাজ করেছে? উচ্চ বর্ণের অনেক ব্রাহ্মণই পীরালিদের অন্নগ্রহণ করতেন না, সেই জন্যই কি ব্রহ্মময়ী মন্দির ও সংস্কৃত কলেজের সাথে যুক্ত ব্রাহ্মণদের ঢালাও অন্নদানের ব্যবস্থা ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য চাই প্রয়োজনীয় তথ্য। প্রায় ১০০ বছর আগে পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর বাড়ীতে যে ‘গোপীনাথ জিউ’ ছিলেন তাঁকে ব্রহ্মময়ী মন্দিরের পাশে এনে প্রতিষ্ঠা করা হয়। গোপীনাথ এখানেই অধিষ্ঠিত। 


ব্রহ্মময়ী মন্দির ঘিরে নানা অলৌকিক ঘটনা প্রচারিত। তার সব হয়তো সত্যি নয়। দেবী এখানে পশ্চিমাস্যা হওয়ার কারণ হিসাবে বলা হয় রামপ্রসাদ যখন ভাগীরথী দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাঁর গান শোনার জন্য দেবী পশ্চিম দিকে মুখ ফেরান। সাধক রামপ্রসাদ সেন মারা যান ১৭৭২ খ্রীঃ আর মন্দির তৈরি হয় ১৮০৯ এ। সুতরাং এই ঘটনা সত্য নয়। 


এরকম আরও একটি ঘটনা শোনাযায় যে, রানী রাসমণি বজ্রায় করে নদীপথে কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার সময় এই মন্দিরটি দেখে মুগ্ধ হন। এরপর এই মন্দিরের আদলে তিনি দক্ষিনেশ্বর মন্দিরটি নির্মাণ করেন। শ্যামনগর ব্রহ্মময়ী কালীবাড়ির প্রায় আটচল্লিশ বছর পরে দক্ষিনেশ্বর মন্দির স্থাপিত হয়েছে। এই তথ্যটি মন্দির কতৃপক্ষের থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সঙ্গে বামাক্ষ্যাপা এই মন্দিরে নিজে পূজা করেছিলেন। মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত তাঁরা এ নিয়ে গর্ব করেন। পৌষ মাসে জোড়া মুলো দিয়ে পূজো দেবার জন্য বহু দূর দূরান্ত থেকেও ভক্তজনের আগমন ঘটে।

ঋণ - শ্রী নিমাই চট্টোপাধ্যায় (প্রধান পুরোহিত, শ্যামনগর ব্রহ্মময়ী কালীবাড়ি)



Popular posts from this blog

আদ্যাপীঠ মন্দিরের ইতিহাস এবং মহাফলপ্রদ আদ্যাস্তোত্র

কার্ত্তিক পুজোর ইতিকথা

ভাইফোঁটা : যম-যমুনার পুরাণকাহিনি থেকে নন্দীবর্ধন-অনসূয়ার ইতিহাস